মোহাম্মদ আব্দুছ ছালাম মোল্লা
প্রভাষক, পদার্থবিজ্ঞান, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা।
প্রকৃতি জগতের প্রত্যেক প্রাণীরই তার স্বজাতির সাথে ভাবের আদান-প্রদানের সাধারণ মাধ্যম শব্দ।শব্দ এমন এক প্রকারশক্তি, যা কোন কম্পনশীল বস্তু হতে উৎপন্ন হয়ে জড় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে এসে আমাদের কানে শ্রবনের অনুভূতি জাগায় বাজাগাতে চেষ্টা করে।
কিছু কিছু শব্দ যেমন- পাতার মর্মর ধ্বনি, নদীর কুলুকুলুরব, পাখিরকল-কাকলি, গানের সুমধুর সুর আমাদের মনকে মুগ্ধ করে।পক্ষান্তরে গোলমাল বাহট্টগোল কিংবাতীব্রশব্দ বা শব্দের আধিক্য আমাদের শরীর ও মনে ক্লান্তি নিয়ে আসে এবং অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।তাহলে শব্দ দূষণ কি?
“শব্দের
আধিক্য আমাদের শরীর ও মনের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাই পরিবেশের শব্দদূষণ।”
নানা কারণে শব্দদূষণ
হয়ে থাকে। শব্দদূষণের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কারণসমূহ দায়ী
হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু-একটি প্রাকৃতিক কারণেও শব্দদূষণ হয়। মেঘের গর্জন, ঝড়ের
সময় বায়ু প্রবাহজনিত তীব্র শব্দ, সমুদ্রের গর্জন, পশুপাখির উচ্চ কণ্ঠধ্বনি যেমন-
বাঘের গর্জন, কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দ, কাকের সমস্বরে কা-কা শব্দ করা ইত্যাদি
প্রাকৃতিক কারণে সাধারণত শব্দদূষণ ঘটে।
মনুষ্য
সৃষ্ট কারণসমূহঃ
(১)
শব্দদূষণের অন্যতম কারণ পরিবহণ। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে শহর, নগর, বন্দর,
বৃদ্ধির সাথে বাস, ট্রাক, ট্রেন প্রভৃতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব যানবাহনের ইঞ্জিনের
শব্দ এবং এগুলোতে ব্যবহৃত উচ্চ মাত্রার হর্নের আওয়াজ শব্দদূষণের অন্যতম কারণ।
(২)
শিল্প কারখানায় বিভিন্ন যন্ত্র হতে উৎপন্ন শব্দ, শব্দদূষণ করে।
(৩)
উচ্চ শব্দে রেডিও বা লাউড স্পিকারে গান বাজালে শব্দদূষণ হয়।
(৪)
মাইকের আওয়াজ; যেমনঃ নির্বাচনী প্রচার, বক্তৃতা, ধর্মীয় সভা, লটারীর টিকিট ক্রয়ের
আহ্বান ইত্যাদি শব্দদূষণ করে।
সাধারণ
শব্দের তীব্রতা পরিমাপক ডেসিবেল (মানদণ্ড) এবং শব্দদূষণঃ
শ্রবণানুভূতি
সৃষ্টিকারী সাধারণ শব্দের ‘ন্যূনতম তীব্রতা’ বা ‘প্রমাণ তীব্রতা মাত্রা’Acoustical Society of America দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। সোসাইটির নির্ধারণ
অনুসারে সাধারণ শব্দের শ্রবণানুভূতি
সৃষ্টিকারীপ্রমাণ তীব্রতা মাত্রা হচ্ছে শূন্য ডেসিবেল। সোসাইটি নির্ধারিত এই ডেসিবেল স্কেল তীব্রতা মানের একটি লগ স্কেল। এই স্কেল অনুসারে শব্দেরতীব্রতা মাত্রা ০ হতে ১৪০ ডেসিবেলের যে কোনো মাত্রায় কানের শ্রুতিগ্রাহক অঙ্গ ‘অর্গান অব কর্টি’র ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতির মাত্রা ডেসিবেল স্কেলের উচ্চতম তীব্রতা মাত্রায় (৭০-১৪০ ডেসিবেল) সর্বাপেক্ষায় বেশি।
সৃষ্টিকারীপ্রমাণ তীব্রতা মাত্রা হচ্ছে শূন্য ডেসিবেল। সোসাইটি নির্ধারিত এই ডেসিবেল স্কেল তীব্রতা মানের একটি লগ স্কেল। এই স্কেল অনুসারে শব্দেরতীব্রতা মাত্রা ০ হতে ১৪০ ডেসিবেলের যে কোনো মাত্রায় কানের শ্রুতিগ্রাহক অঙ্গ ‘অর্গান অব কর্টি’র ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতির মাত্রা ডেসিবেল স্কেলের উচ্চতম তীব্রতা মাত্রায় (৭০-১৪০ ডেসিবেল) সর্বাপেক্ষায় বেশি।
এক নজরে মনুষ্য
সৃষ্ট শব্দের বিভিন্ন উৎস, শব্দের তীব্রতা এবং শ্রবণেন্দ্রীয়ের উপর প্রভাবঃ
শব্দের উৎস
|
শব্দের তীব্রতা (ডেসিবেল)
|
শ্রবণেন্দ্রীয়ের উপর প্রভাব
|
রকেট উৎক্ষেপণ
|
১৮০
|
অস্বস্তিকর বা যন্ত্রণাদায়ক
|
জেট বিমান
|
১৪০
|
|
বজ্রপাত
|
১২০
|
|
রকেট
|
১১৫
|
কান ফাটা বা কানে তালা লাগা
|
কামান
|
১১০
|
|
এরোপ্লেন বা বয়লার বা ফ্যাক্টরি
|
১০০
|
খুব তীব্র শব্দ
|
পাতাল ট্রেন
|
৯০
|
|
ব্যস্ত রাস্তা বা শহরে কলকারখানা
|
৮০
|
মধ্যম তীব্র শব্দ
|
রেডিও (খুব জোরে বাজালে)
|
৭০
|
|
সাধারণ কথাবার্তা
|
৬০
|
স্বাভাবিক শব্দ/মৃদু শব্দ
|
অফিস বা বাসা-বাড়ি
|
৪০
|
|
শান্ত অফিস বা বাসা-বাড়ি
|
৩০
|
অতি ক্ষুদ্র শব্দ
|
ফিসফিস
|
২০
|
|
গাছের পাতা ঝরা
|
১০
|
অতি কষ্টে শোনা যায়
|
শ্রাব্যতা সীমা
|
০
|
এবার আসা
যাক ডেসিবেল কী?
‘বেল’ এবং ডেসিবেল
হচ্ছে শব্দের তীব্রতা নির্দেশক একক।
শব্দ দূষণের
প্রভাবঃ
শব্দ দূষণের
ক্ষতিকর প্রভাবগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
১। শ্রুতিযন্ত্রীয়
ফলঃ
(ক) হঠাৎ
অতি উচ্চ মাত্রার (৭০-১৪০ ডেসিবেল) শব্দের প্রভাবে মানুষের শ্রবণতন্ত্রের মারাত্মক
ক্ষতি সাধন হতে পারে। এমনকি কর্ণপটই ছিঁড়ে যেতে পারে।
(খ) সপ্তাহে
৪০ ঘণ্টা করে ৯০ডেসিবেল শব্দ মাত্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করে শেষ জীবনে চাকুরী থেকে
অবসর নেয়ার সময় বধিরতা দেখা দেয়।
(গ) সাময়িক
৯০ডেসিবেল শব্দ মাত্রায় শ্রুতি ক্লান্তি ঘটে। তার সাথে উপসর্গ হিসেবে যোগ হয় কানে
ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে থাকা।
(ঘ) ১২০-১৫০ডেসিবেল
শব্দ মাত্রায় মানুষ পুরোপুরি বধির হয়ে যায়।
(ঙ) শ্রুতি
ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় উচ্চ
শব্দযুক্ত শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের শ্রবণশক্তি ১০ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হয়ে
যায়।
২। শ্রুতিযন্ত্র
বহির্ভুত ফলঃ
(ক) মেজাজ
খিটখিটে হয়।
(খ)
পড়া-শুনা বা কাজে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় এবং ভুল সিদ্ধান্তের প্রবণতা বাড়ায়।
(গ) ৫০-৬০
ডেসিবেল শব্দ মাত্রার দূষণ সংলাপ যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটায় এবং অনের সময় শব্দের সংকেত
বা সাবধানবাণী সম্বন্ধে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
(ঘ) অতি
উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্বসনের হার পরিবর্তিত হয়। ফলে মানুষ শ্বাস
কষ্টজনিত রোগে ভোগে।
(ঙ) শব্দ
দূষণের ফলে দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়।
(চ)
রক্তবাহিকা সংকুচিত হয়ে হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়। ফলে হৃদপেশীর
কর্মক্ষমতা করে যায়, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে, ত্বক ফ্যাকাসে হয় ও মাংসপেশী
উত্তেজনায় কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া ধমনী কাঠিন্যতা প্রাপ্ত হয়ে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন
ঘটায়। এতে হৃদরোগ, খেয়ালপনা প্রভৃতি রোগের সৃষ্টি হয়।
(ছ) শব্দ
দূষণের ফলে পাকস্থলিতে অম্লতা বেড়ে পরিপাকের বিঘ্ন ঘটায় এবং আলসারের সৃষ্টি করে।
(জ)
বিমানবন্দর সংলগ্ন অধিবাসী মহিলাদের প্রায়ই ভ্রুণ বিচ্যুতি ঘটে কিংবা কম ওজনের
শিশু ভূমিষ্ঠ হয়।
(ঝ) শব্দ
দূষণের কারণে শিশুরা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে।
(ঞ) শব্দ
দূষণের প্রভাবে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতাযুক্ত কাজে একাগ্রতা
বিঘ্নিত হয়, তাছাড়া মাথা ধরা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি উপসর্গের
আবির্ভাব ঘটে।
বিবর্ধিত
শব্দের ব্যাপকতায় শব্দ দূষণ বর্তমানে গভীর উদ্বেগের বিষয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের
বিজ্ঞানীরা শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরণের চিন্তা ভাবনা করছেন। নিম্নলিখিত
ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
১। আইন
প্রনয়ণের মাধ্যমে।
২।
হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে।
৩। অনাবাসিক
এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে।
৪। শব্দ
অপরিবাহী পর্দার মাধ্যমে।
৫। ‘ইয়ার
প্লাগ’ ব্যবহারের মাধ্যমে।
৬। বোমা
বিস্ফোরণ নিষিদ্ধের মাধ্যমে।
৭। ইলেক্ট্রনিক্স
দোকানে গান-বাজনা বন্ধের মাধ্যমে।
৮। মিটিং
মিছিলে মাইকের ব্যবহার সীমিতকরণের মাধ্যমে।
৯। স্বল্প
স্বরে গান শোনা ও টিভি দেখার মাধ্যমে।
সর্বোপরি
মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা
সম্ভব। এজন্য স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে ও প্রচার মাধ্যমগুলোতে শব্দ দূষণের ক্ষতিকর
প্রভাব সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
(y)
উত্তরমুছুন