বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

কি করে বানাইব আমি পরশপাথর ???



পরশপাথর নামে রবিঠাকুরের কবিতা আছে একটা-
ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
মাথায় বৃহৎ জটা             ধূলায় কাদায় কটা,
মলিন ছায়ার মত ক্ষীণ কলেবর।
আবার একটা কঠিন রকমের ভাব সম্প্রসারণও অনেকের মুখস্ত, দুখের মতন এত বড় পরশপাথর আর নাই। তার উপর হ্যারি পটারের প্রথম বইয়ের নামেও পরশপাথর, Harry Potter and the Philosopher Stone। আস্তে আস্তে টের পাওয়া যাচ্ছে পরশপাথর মোটেও হেলাফেলার বস্তু নয়। কিন্তু জিনিসটা কি?

যে বস্তুর পরশে সস্তা ধাতু সোনা হয়ে যায়, তাই পরশপাথর। গ্রীক পুরাণে যে রাজা মিডাসের কথা আছে, যার ছোঁয়ায় সব কিছু সোনা হয়ে যায়, তাকেই বা আমরা জৈবিক পরশ পাথর বলি না কেন? কিন্তু কর্মকাণ্ড তো সব ছু-মন্তর আর আব্রা-কা-ডাব্রার মতই লাগে, বিজ্ঞান এর মাঝে ঢুকে গেল কোথা থেকে?

মোটেও দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কারণ আজপর্যন্ত যে সব ক্ষ্যাপারা খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন পরশপাথর, তাঁরা একরকম খাঁটি বিজ্ঞানী। যেমন, আমাদের সবার অতিপরিচিত স্যার আইজ্যাক নিউটন। পরশপাথর বানাতে গিয়ে এই বুদ্ধিমান ক্ষ্যাপাগণ যে বিজ্ঞানকে কতটা এগিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা নিজেরা জানতেন?

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি সভ্যতায় পরশপাথরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারত, চিন, মিশর, গ্রিস; সবখানে কোন না কোনভাবে গড়ে উঠেছিল অ্যালকেমি, পরশপাথর খোঁজার বিদ্যা। অবশ্য অ্যালকেমির পরশপাথর যে কেবল সীসাকে সোনা বানাতে পারে তা নয়। হাজার হাজার অ্যালকেমিস্ট স্বপ্নের পরশপাথরের সাথে তালাশ করেছেন দেব-দানবের বাসুকির লেজ ধরে সমুদ্র উপচে ফেলে তোলে আনা অমৃতের, যার গুণে পলকা মানব জাতি অমর হয়ে যায়। । কিন্তু অমৃত তো দূরের কথা, পেনিসিলিন আবিষ্কার হতে হতেই বহু বছর লেগে গেছে। নয়তো আজকাল আমরা সকলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিতাম, আর অলিম্পাসের চূড়ায় উঠে হয়তো গ্রীসের দেবতাদের টিটকারিও মারতাম, কয়লার মত কালো, অ্যাপোলো, অ্যাপোলো!
প্রথম প্রথম অ্যালকেমি অনেকদিন আধ্যাত্মিকতার খাঁচায় বন্ধ ছিল , পরশপাথর অন্বেষীরা খুব একটা বাস্তবসম্মত উপায় ব্যবহার করেননি। অ্যালকেমিকে প্রথমবারের মত বিজ্ঞানের কাছাকাছি নিয়ে আসার কৃতিত্ব দিতে হবে জাবির ইবনে হাইয়ানকে।
জাবির ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ চালান, অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও করে বসেন (যেমন aqua regia বা রাজ অম্ল। হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর নাইট্রিক এসিডের যৌথ প্রয়াস। দুনিয়াতে যে গুটিকয়েক পদার্থ আছে যারা সোনা নামের বহুমূল্য ধাতুটিকে আক্রমণ করতে পারে তাদের একটি)। অ্যালকেমি নামটিও জাবিরের দেওয়া।


অ্যালকেমিস্টরা তো অনেক বড় বড় কাজ করলেন। নানান রকম ধাতু অধাতুর শখানেক ধর্ম বের করলেন, এদের নিষ্কাশন পদ্ধতি বের করলেন, অনেক রকমের ওষুধ-পথ্যও আবিষ্কার করলেন। কিন্তু সীসা আর সোনা হয় না। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলো বিজ্ঞানের রেনেসাঁর প্রথমভাগ, বয়েল-নিউটনদের যুগ।
রবার্ট বয়েল অ্যালকেমির উপর নানান ধরনের কাজ করেছেন, পাকা বিজ্ঞানীর হাত দিয়ে(বয়েল অবশ্য পাকা বিজ্ঞানীই ছিলেন)। তিনি ল্যাবরেটরিতে অনেক অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। তবে, বয়েলের একটা মজার স্বভাব ছিল। কোন সম্ভাবনাকেই তিনি বাদ দিতে চাইতেন না। যে কারণে কেমিক্যাল আর ধাতু-অধাতু নিয়ে কাজ করার সময় চাঁদ-সূর্য কোনদিকে উঠেছে কিংবা বায়ুর চাপ কত; সে হিসেবও রাখতেন তিনি! বলা তো যায়না কখন কাজে লেগে যায়। বয়েলের এমন সব প্রক্রিয়াই আস্তে আস্তে আধুনিক রসায়নের সূচনা করেছিল(মজার কথা হচ্ছে, সংস্কৃত রসায়ন শব্দটি প্রাচীনকালে যে বিদ্যার পিছনে ব্যবহৃত হত তাকে ভারতীয় অ্যালকেমি বলা যায়)। নিউটন অ্যালকেমি নিয়ে মারাত্মক গবেষণা করেছিলেন, এবং অ্যালকেমির উপর পড়াশুনা তার মহাকর্ষ তত্ত্বকেও প্রভাবিত করেছিল! আর এটা তো বুঝাই যাচ্ছে Chemistry শব্দটি এসেছে Alchemy থেকে। সপ্তদশ শতাব্দীতেই অ্যালকেমিকে কেমিস্ট্রি নামে ডাকা শুরু হয়। 


অ্যালকেমির উপর মানুষের এতটা বিশ্বাস থাকার কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। মানুষের চোখের সামনেই অনেক রকম রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, এক পদার্থ বদলে অন্য পদার্থ হয়ে যায়। অবশ্য সব রাসায়নিক পরিবর্তনই কিছু নিয়ম মেনে হয়, কিন্তু প্রাচীনকালের অ্যালকেমিস্টরা তো আর তা জানতেন না। তাই তাদের ধারনা জন্মেছিল যেকোনো ধাতুকেই সোনায় পরিণত করা সম্ভব। এক পদার্থের অন্য পদার্থে রূপান্তরকে অ্যালকেমির ভাষায় বলা হত ট্রান্সমিউটেশন।

জন ডালটনের পরমাণুবাদ অ্যালকেমির উপর বড় আঘাত করে বসল শেষপর্যন্ত। ডালটনের তত্ত্ব থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়া কেমন করে ঘটে তার একটা ধারনা পাওয়া গেল। তার মাত্র কিছুদিন পর অ্যাভোগ্যাড্রো আর ক্যানিজারো অণু আবিষ্কার করে বসেন। তাতে বুঝা গেল, রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোতে পরমাণু একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে অণু গঠন করে, নতুন যৌগ গঠন করে। কিন্তু এক মৌলের পরমাণু অন্য মৌলের পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে পারে না। কার্বন ও অক্সিজেন মিলে কার্বন ডাই অক্সাইড হতে পারে, কিন্তু কার্বন অক্সিজেন হয়ে যায় না। তেমনি সীসা-পারদ-লোহা যাই আনা হোক, পরশপাথর তাদের সোনা বানাতে পারবে না।
জলরাশি অবিরল                       করিতেছে কলকল,
অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।
কাম্য ধন আছে কোথা                  জানে যেন সব কথা,
সে ভাষা যে বুঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।

ধারনা করা হতো পরমাণু কেবল তিন ধরনের কণা দিয়ে গঠিত; ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। কিন্তু এই তিন ধরনের কণার মাঝে ইলেকট্রনই একমাত্র মৌলিক কণা। প্রোটন ও নিউট্রনও আসলে কোয়ার্ক নিয়ে গঠিত।

মৌলিক কণাদের, আরও ভাল করে বলতে গেলে পদার্থ গঠনকারী মৌলিক কণাদের(সব মৌলিক কণা পদার্থ গঠন করতে পারে না) দুটি শ্রেণি আছে, লেপটন এবং কোয়ার্ক। ইলেকট্রন একটি লেপটন। একটি বিচ্ছিন্ন কোয়ার্ক কখনও প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া যায় না, কোয়ার্ক সবসময় দলবেঁধে থাকে। তিনটি কোয়ার্ক একসাথে থাকলে তাদের বলে ব্যারিয়ন, একটি কোয়ার্ক এবং তার অ্যান্টিকোয়ার্ক হল মেসন।
আমাদের অতিপরিচিত প্রোটন এবং নিউট্রন কিন্তু ব্যারিয়ন কণা। কোয়ার্কের আবার Flavors বা স্বাদ ও থাকে। ছয় ফ্লেভারের কোয়ার্ক পাওয়া যায় Up, Down, Strange, Charmed, Top, Bottom (আমরা নিজেরা এদের দায়সারা রকম বাংলা নামও দিয়ে দিতে পারি : উপর, নিচ, তাজ্জব, বিমুগ্ধ, শীর্ষ, তলা)। প্রোটন দুটি আপ একটি ডাউন এবং নিউট্রিনো দুটি ডাউন একটি আপ কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি।
কিন্তু ব্যারিয়নে যে কোয়ার্কগুলো থাকে, তাদের তো কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখতে হয়। কোয়ার্করা এমনিতেই যথেষ্ট ফাজিল, একটু এদিক সেদিক হলে কোন প্রকার কণা গঠন করে না। ওদের আটকে রাখতে গেলে তাই অনেক শক্তিশালী কোন বল প্রয়োজন।

এই বলকেই বলা হয় Color Force। কোয়ার্কের রঙের ধারনা থেকে এই নাম এসেছে। কোয়ার্কের রঙ আবার কি? কোয়ার্ক আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকেও অনেক ছোট, তবে এর রঙ কেমন করে হয়?

আসলে কোয়ার্কের বিভিন্ন প্রকারভেদ বুঝানোর জন্য বিজ্ঞানীরা রঙের নাম ব্যবহার করেন। সেই হিসেবে তিন রঙের কোয়ার্ক আছে সবুজ, লাল, নীল। যেমন প্রোটনের তিনটি কোয়ার্কের একটি সবুজ, একটি লাল, একটি নীল হতে হয়। আবার কোয়ার্কের অ্যান্টিকোয়ার্কের অ্যান্টি কালার হয়। কোন একটি মেসনের একটি কোয়ার্কের রঙ যদি Blue হয় তবে অপরটির হবে anti Blue। কিন্তু সবুজ কোয়ার্ক দেখতে আসলে মোটেও সবুজ নয়।

কালার ফোর্স মারাত্মক শক্তিশালী বল। কোয়ার্ক বাঁধার পরও কণার আশেপাশে এই বল কাজ করতে পারে। তখন একে বলা হয় Strong Nuclear Force বা সবল বল বা Strong Force। সত্যি বলতে প্রকৃতির চার প্রকার মৌলিক বলের মাঝে স্ট্রংফোর্স(বা কালার ফোর্স) সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই বল খুব বেশি দূরে ক্রিয়াশীল হতে পারে না। ঠিক যেন হাত-পা কাটা দানব।

প্রোটনের চার্জ পজিটিভ, ইলেকট্রনের নেগেটিভ, নিউট্রনের চার্জ থাকেই না। পরমাণুর কেন্দ্রে বা নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন, তার চারপাশে ইলেকট্রন ঘুরে বেড়ায়। চার্জহীন সাধারণ পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান থাকে, আর প্রোটন সংখ্যাই হচ্ছে পারমাণবিক সংখ্যা। প্রতিটি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। তবে মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রন সংখ্যা কিন্তু পারমাণবিক সংখ্যা নয়। লোহার পরমাণুতে ২৬ টি প্রোটন এবং ২৬ টি ইলেকট্রন থাকে। এর প্রোটন সংখ্যা ২ বেড়ে গেলে তাকে আর লোহা বলা যাবে না, নিকেল বলতে হবে। কিন্তু ইলেকট্রন ২ বেড়ে গেলে লোহা লোহাই থাকবে, ধাতু নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়ে যাবে, এই যা।

নিউক্লিয়াসের প্রোটন এবং নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে বলে ভরসংখ্যা। প্রোটন আর নিউট্রনের ভর প্রায় সমান বলে ভরসংখ্যাকে সেই ভর দিয়ে গুণ করে পরমাণুর মোট ভরটা প্রায় নিখুঁতভাবে বের করে ফেলা  যায়। ইলেকট্রনের ভর কিন্তু একেবারেই কম, তাই হিসেব থেকে ওকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় এবং এতে খুব একটা সমস্যাও হয় না।
নিউক্লিয়াসে যে প্রোটন থাকে তাদের চার্জ পজিটিভ। অর্থাৎ প্রোটনগুলোর পরস্পরের মাঝে যে তড়িৎ চুম্বকীয় বল বা Electromagnetic force কাজ করে তা সমধর্মী। সমধর্মী তড়িৎ চুম্বকীয় বল পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে, তার উপর এই বল যথেষ্ট শক্তিশালী বলে বিকর্ষণের পরিমাণও মোটেও কম হবে না। তাহলে নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রনগুলো আটকে থাকে কেমন করে? মহাকর্ষ বল এর এত ক্ষমতা নেই ছোট ছোট কণাকে আটকে রাখবে, তবে?

আটকে রাখে সেই স্ট্রং ফোর্স। কিন্তু সমস্যাটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, স্ট্রং ফোর্সের সীমা একেবারেই ছোট। তাই নিউক্লিয়াসের আকার বেশি বড় হয়ে গেলে কিংবা প্রোটন-নিউট্রন অনুপাতে বড় রকমর তারতম্য হলে স্ট্রং ফোর্স খোঁড়া হয়ে যায়। একটি নিউট্রন ভেঙে ইলেকট্রন ও প্রোটন হয়ে যায়, আর ছিটকে বের হয়ে আসে আলফা রশ্মি বা বিটা রশ্মি হয়ে; কখনও কেবল তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বের হয় গামা রশ্মি রূপে।

১৮৯৬ সালে হেনরি বেকরেল ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে এই কাজ করতে দেখেছিলেন, কোনভাবে মৌলটিকে প্রভাবিত না করার পরও। ইউরেনিয়াম হতে আপনা আপনিই রশ্মিগুলো তিনি বের হতে দেখেন, যদিও তখন তিনি জানতেন না এগুলো আসলে কি। এই প্রক্রিয়াকে বলে তেজস্ক্রিয়তা বা Radio-activity। বলে রাখা ভাল, তেজস্ক্রিয় রশ্মিরা কিন্তু বান্দা হিসেবে মোটেও সুবিধার নয়। বিজ্ঞানী মেরি কুরির মৃত্যুর জন্য রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তাকেই দায়ী করা হয়।

১৯০১ সালে রাদারফোর্ড এবং তার ছাত্র ফ্রেডরিক সোডি তেজস্ক্রিয় থোরিয়াম নিয়ে গবেষণা করছিলেন। থোরিয়াম থেকে আলফা বিকিরণ হচ্ছিল। আলফা বিকিরণ হলে নিউক্লিয়াস থেকে দুইটি প্রোটন ও দুইটি নিউট্রন বের হয়ে আসে ( হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে দুইটি করে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে বলে আলফা বিকিরণকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের প্রবাহও বলা হয়)।
ঘটনাটা আসলে কি হচ্ছিল? থোরিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা 90। যতগুলো নিউট্রনই বের হোক না কেন, আলফা বিকিরণের ফলে দুইটি প্রোটন নিউক্লিয়াস থেকে বের হয়ে আসে বলে পারমাণবিক সংখ্যা কমে হয়ে যায় 88। তারমানে থোরিয়াম পরমাণুগুলো আস্তে আস্তে পরিণত হয়ে গেল রেডিয়ামে! ট্রান্সমিউটেশন!

সোডি অ্যালকেমি নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন, এই ফলাফল তাকেও চমকে দিল। তিনি হতভম্ব হয়ে রাদারফোর্ডকে বললেন, অই রাদারফোর্ড, দেখেছ? এ যে নির্ঘাত ট্রান্সমিউটেশন!

সেকালে অ্যালকেমির অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না। রাদারফোর্ড তাড়াতাড়ি বললেন, কসম সোডি, একে ট্রান্সমিউটেশন বলা বন্ধ কর। নয়তো মানুষ অ্যালকেমিস্ট ভেবে আমাদের কল্লা আলাদা করে ফেলবে।

রাদারফোর্ডের হুমকি অবশ্য কাজে আসেনি। এই নিউক্লিয়ার রূপান্তরকে আজ ট্রান্সমিউটেশনই (Transmutation) ই বলা হয়।

এতো গেল একরকমের তেজস্ক্রিয় রূপান্তর, আরও অনেকভাবে ট্রান্সমিউটেশন হতে পারে। যেমন বিটা রেডিয়েশনের প্রভাবে পারমাণবিক সংখ্যা বেড়েও যেতে পারে। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার হাত ধরেই কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হল। অ্যালুমিনিয়ামকে আলফা কণা দ্বারা আক্রমণ করলে তা তেজস্ক্রিয় ফসফরাসে পরিণত হয়, সেই তেজস্ক্রিয় ফসফরাস আবার তেজস্ক্রিয়তার কারণে অন্য মৌলে বদলে যায়।

নিউক্লিয়াসকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা সবাই মেতে উঠলেন। দেখা গেল যে, অন্য উপায়েও নিউক্লিয়ার পরিবর্তন সম্ভব। যেমন ছোটখাটো দুটি নিউক্লিয়াস এক করে দেওয়া যেতে পারে, যাকে বলে ফিউশান। কিংবা আঘাত করে একটি নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলা যায়, যাকে বলে ফিশান।

ফিউশান বা ফিশান প্রক্রিয়ার নিঃসন্দেহে এক মৌলকে অন্য মৌলতে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আবার এক ছোট সমস্যা দরজায় টোকা মারবে। ফিউশান = হাইড্রোজেন বোমা, ফিশান = অ্যাটম বোমা। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া মানেই বিপুল পরিমাণ শক্তির সৃষ্টি। সেই শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বাংলা সিনেমার হিরো নাকি তামিলনাড়ুর রজনীকান্ত?

সিনেমার কথা থাক। শেষপর্যন্ত পরশপাথর সম্ভবত আমরা পেয়ে গেছি (ঘুরে ফিরে অবশ্য সিনেমার কথাই আসতে পারে, সত্যজিৎ রায়ের একটা সিনেমা আছে পরশপাথর নামের)। কিন্তু এই পাথর নয় সাধারণ, একেবারে ঝাপ মেরে নিউক্লিয়ার পরিবর্তন। নিউক্লিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা কি অপর কোন ধাতুকে সোনায় পরিবর্তন করতে পারব?

কোন মৌলের বিভিন্ন ভরসংখ্যা (আবার মনে করা যাক, ভরসংখ্যা মানে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যার যোগফল) বিশিষ্ট পরমাণু থাকতে পারে। ইউরেনিয়ামের কথা ধরা যাক। আমরা জানি ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা 92। ইউরেনিয়ামের কিছু পরমাণুতে নিউট্রন থাকে 143 টি , ভরসংখ্যা 235 এবং ঐ ইউরেনিয়ামকে ডাকা হয় U-235। তেমনি 238 ভরসংখ্যা বিশিষ্ট ইউরেনিয়াম U-238। আলাদা আলাদা ভরসংখ্যা বিশিষ্ট একই মৌলের পরমাণুদের ডাকা হয় একে অপরের আইসোটোপ নামে। যেমন U-235 আর U-238 একে অপরের আইসোটোপ। আমাদের অতিপরিচিত মৌল হাইড্রোজেনেরও কিন্তু দুইখানা আইসোটোপ আছে, ডিউটেরিয়াম আর ট্রিটিয়াম।

সোনার পারমাণবিক সংখ্যা 79। সোনার যে সমস্ত আইসোটোপ পাওয়া যায় তাদের মাঝে Au-197 বাদে প্রতিটিই তেজস্ক্রিয়। তাই নিউক্লিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা যে সোনা বানাব তা যে টিকে থাকবে প্রকৃতিতে, তেমন আশা করা দুরাশার সমান।

আসলে কি, অন্য ধাতু থেকে সোনা বানানো ইতোমধ্যেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৪১ সালে পারদকে অত্যন্ত দ্রুতগামী নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে খুব অল্প পরিমাণ সোনা বানানো হয়েছিল। কিন্তু যা ঘটবার ছিল ঘটল তাই, ঐ সোনা ছিল তেজস্ক্রিয়। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই যে গুটিকয়েক সোনার পরমাণু ছিল তারা বিকিরণ করে গেল বদলে।

সবচেয়ে মজার কাজটা হয়েছিল আরও পরে। একটা নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারের নিউক্লিয়ার চুল্লীর চারপাশে সীসার দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছিল। বিকিরণের প্রভাবে সেই সীসা কখন যেন সোনা হয়ে গেছে, কেউ টের পায়নি (তেজস্ক্রিয় সোনা অবশ্য)!

তবে কি স্বাভাবিক সোনা আমরা বানাতে পারব না?

এই প্রশ্ন নিয়ে ঘাটাঘাটি করে শেষপর্যন্ত এক ওয়েবসাইটে মজার পদ্ধতি পাওয়া গেলাম একটা। পারদের পারমাণবিক সংখ্যা সোনার চেয়ে 1 বেশি, 80। আমাদের পারদের Hg-196 আইসোটোপ নিতে হবে। তারপর এর নিউক্লিয়াসকে কোন বিচ্ছিন্ন নিউট্রন দিয়ে আঘাত করতে হবে। কিন্তু আঘাতটা বেশি জোরে করা যাবে না, কারণ আমরা এবার নিউক্লিয়াস ভাঙতে চাই না, আমরা চাই নিউক্লিয়াস নিউট্রনটি গ্রহণ করুক।

নিউক্লিয়াস নিউট্রনটি গ্রহণ যদি করেই ফেলে, তবে হয়ে যাবে অস্থিতিশীল বা তেজস্ক্রিয়। তখন কিন্তু পরমাণুটি Hg-196 থাকবে না, Hg-197 হয়ে যাবে। মানে 80 টি প্রোটন ও 117 টি নিউট্রন নিউক্লিয়াসে।

এই অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াস একসময় তার আশেপাশের একটি ইলেকট্রনকে ধরে নিজের একটি প্রোটনের সাথে জুড়ে দিয়ে নিউট্রন বানিয়ে ফেলে এবং একটি নিউট্রিনো ছেড়ে দেয়।

তারমানে বর্তমানে নিউক্লিয়াসের প্রোটন 79 টি, নিউট্রন 118 টি, ভরসংখ্যা 197। সোনার Au-197 আইসোটোপ আমরা পেয়ে গেছি!

খুবই ভাল পদ্ধতি, সন্দেহ নেই। কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা থেকেই যাবে।

এত কষ্ট করে সোনা বানাতে আপনার যে পরিমাণ খরচ হবে, তা দিয়ে রাশি রাশি সোনা এমনিতেই কেনা সম্ভব। কি দরকার এত সমস্যা করার?


সুতরাং পরশপাথরের ছোঁয়ায় ধাতু স্বর্ণ হয়ে যাবে, এমন ধারনা আজকাল অমূলক। নিউক্লিয়ার পরিবর্তনের ফলে সোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্ভব, কিন্তু যেমন ঝামেলার, তেমন খরচের।
কিন্তু প্রক্রিয়াটা বিজ্ঞানীরা অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। কত আজিব ঘটনাই না প্রকৃতিতে ঘটতে পারে যা আমরা এখন হয়তো কল্পণা করতেও পারি না। অ্যালকেমি দুনিয়াকে পরশপাথর বের করে দিতে পারেনি, সে তো হ্যারি পটারের পকেটেই আছে, কিন্তু তার থেকেও দামী কিছু দিয়েছে। কৃত্রিম প্রাণ তো মানুষ বানিয়েই ফেলেছে কিছুদিন আগেই। খুব তাড়াতাড়িই আরও কঠিন কিছু আমরা হয়তো করে ফেলব, যা দেখে আমাদের নিজেদের চোখই ট্যারা হয়ে যাবে।

এবার কেবল চোখে স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা, দেখা যাক সামনে আরও কি কি হয়!

অর্ধেক জীবন খুঁজি                     কোনক্ষণে চক্ষু বুজি
স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ                       আবার করেছি দান
ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর।


অবিশেষ দ্রষ্টব্যাবলি

1. পরশপাথর
   কাব্যগ্রন্থ : সোনার তরী
   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯
   শান্তিনিকেতন
2. Philosopher Stone পরশপাথরের ইংরেজি। উল্লেখ যে, হ্যারি পটারে যে নিকোলাস ফ্লামেল নামের    অ্যালকেমিস্টের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এই নামের একজন অ্যালকেমিস্ট ছিলেন।
3. সমুদ্র উপচে অমৃত তোলার গল্প হিন্দু পুরাণে আছে।
4. অ্যাপোলো প্রাচীন গ্রীসের সূর্য দেবতা।
5. কোয়ার্ক ও মৌলিক বল বিষয়ক বিভিন্ন ধারনা এখনও পর্যবেক্ষণের উপর আছে। অতএব এদের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাকে বর্তমান বিজ্ঞানীরা Standard Model হিসেবে বিবেচনা করলেও যে কোন সময় আরও ভাল মডেল পাওয়া গেলে এই থিওরি বদলে যেতেই পারে।
6. চারটি মৌলিক বলের মাঝে তিনটির উল্লেখ করা হয়েছে। অপরটি Weak Nuclear Force বা দুর্বল নিউক্লিয় বল।
7. মহাকর্ষ বল এমনকি উইক ফোর্সের চেয়েও দুর্বল, অর্থাৎ সবচেয়ে দুর্বল।
8. হাইড্রোজেন বোমা নিউক্লিয়ার ফিউশান এবং অ্যাটম বোমা নিউক্লিয়ার ফিশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে E=mc অনুসারে শক্তি উৎপন্ন করে।
9. 92 পারমাণবিক সংখ্যা ও 235 ভরসংখ্যা বিশিষ্ট U পরমাণুকে এভাবে লেখা যায়
10. যে ওয়েবসাইটে প্রক্রিয়াটি ছিল: http://www.straightdope.com/coloumns/read/3067/can-we-now-transmute-base-substance-into-gold
11. নিউট্রিনো অন্য এক রকমের মৌলিক কণিকা। পরমাণুতে খুব কম সময়ের জন্য এদের অস্তিত্ব বুঝা যায়।

# ছবিগুলো গুগুল থেকে যোগাড় করা।

লিখেছেন ঃ মৃন্ময় আকাশ । পড়াশুনা করছেন নেত্রকনা সরকারি কলেজে , প্রশাষক হিসাবে আছেন "বাংলা লোকসাহিত্য" এ এবং অন্যতম সদস্য "বিজ্ঞান স্কুলের " ।

ফেসবুক আইডিঃ https://www.facebook.com/clay.caelum?ref=notif&notif_t=friend_confirmed 

২টি মন্তব্য: